Connect with us

Website: the-constellation.org

Newsletter EnglishFrench Spanish  

Facebook https://www.facebook.com/pages/The-Constellation/457271687691239  

Twitter @TheConstellati1

Instagramhttps://www.instagram.com/constellationclcp/

Youtube channel: The Constellation SALT-CLCP

যখন কমিউনিটিই নেতৃত্ব দেয়, তখন জ্ঞান হয়ে ওঠে উৎসব

১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ভোর ৫টা ৩০ মিনিট। তখনও আকাশ পুরোপুরি আলোকিত হয়নি। কিন্তু আমাদের ভেতরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর প্রত্যাশার আলো জ্বলছিল। বাংলাদেশ রুরাল ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (BRED) টিম থেকে হুমায়রা আপু, আশিক ভাই, বায়োজিদ ভাই এবং আমি—আমরা সবাই রওনা হলাম গোপালগঞ্জের ব্যাসপুর কমিউনিটির উদ্দেশ্যে। আমাদের ARC কোহর্ট পার্টনার Grow Your Reader Foundation আয়োজিত নলেজ ফেয়ার-এ অংশগ্রহণ করতেই এই যাত্রা।

এবারের নলেজ ফেয়ারটি ছিল একেবারেই আলাদা। এটি ছিল পুরোপুরি কমিউনিটি লেড নলেজ ফেয়ার—যেখানে পরিকল্পনা, আয়োজন, বাস্তবায়ন—সবকিছুর নেতৃত্বেই ছিল কমিউনিটির মানুষ।

সত্যি বলতে কী, যাওয়ার সিদ্ধান্তটা খুব সহজ ছিল না। ১৪ ডিসেম্বর আমাদের নিজেদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্ট ছিল। তাই ভাবছিলাম—এত কিছুর পর আদৌ গোপালগঞ্জ যাওয়া সম্ভব হবে কি না। কিন্তু সেদিন বিকেলে বাসপুর কমিউনিটির নবান্ন উৎসব আর পিঠা-নাড়ু বানানোর ছবি যখন চোখে পড়ল, তখন আর নিজেকে ধরে রাখা গেল না। ছবিগুলোর ভেতর যে আনন্দ, যে প্রাণ, যে আন্তরিকতা—তা আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলাম—আমরা যাবই।

ভাবনা যেমন, কাজও তেমন। ১৪ ডিসেম্বর পাবনা থেকে রওনা হয়ে ঢাকায় আসি। সেখান থেকে ১৫ তারিখ ভোরে আবার গোপালগঞ্জের পথে। যাত্রাটা ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং, আবার একই সাথে ভীষণ রোমাঞ্চকর।

ভোরবেলা যাত্রাবাড়ীর কাছাকাছি একটি গ্যাস পাম্পে গাড়ি থামানোর সময় আমরা এক হৃদয়বিদারক ঘটনার মুখোমুখি হই। প্রায় ৭৫–৮০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ রিকশাচালক হঠাৎ রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। তার শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তার কাছে একটি ইনহেলার ছিল, কিন্তু সম্ভবত সেটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। চেষ্টা করেও তিনি ঠিকভাবে শ্বাস নিতে পারছিলেন না।

এই দৃশ্য প্রথম চোখে পড়ে হুমায়রা আপুর। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বায়েজিদ ভাইকে বিষয়টি দেখতে বলেন। এত বেশি বয়সে প্যাডেল রিকশা চালানোর মতো শারীরিক সক্ষমতা যে এই বৃদ্ধ বাবার আর নেই, তা খুব স্পষ্ট ছিল।

ঠিক সেই সময় আশিক ভাই জানান, তার কাছে একটি ইনটেক ইনহেলার আছে। এক মুহূর্ত দেরি না করে তিনি সেটি ওই বৃদ্ধ বাবার হাতে তুলে দেন। কিছুক্ষণ ইনহেলার নেওয়ার পর তিনি একটু স্বস্তি পান। এরপর প্রিয়া আপু তাকে কিছু নগদ টাকা দিয়ে অনুরোধ করেন যেন তিনি অন্তত এক-দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নেন।

বৃদ্ধ বাবাটি ভীষণ খুশি হন। তার চোখে-মুখে কৃতজ্ঞতার যে ভাষা, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি আমাদের সবাইকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়। জীবনের ভঙ্গুরতা আর মানুষের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতার কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেয়।

এরপর আবার শুরু হয় আমাদের যাত্রা। গাড়ির ভেতর কিছুক্ষণ নীরবতা, কিছুক্ষণ ফিসফিস করে কথা। এদিকে Grow Your Reader Foundation টিম বারবার ফোন করে আমাদের খোঁজ নিচ্ছিলেন। এই আন্তরিকতা—এই মানবিক সম্পর্ক—কখনো ভোলার নয়।

পদ্মা সেতু পার হয়ে আমরা গোপালগঞ্জ পৌঁছাই। সেখানে একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় নাস্তা সেরে সকাল ১০টার দিকে ব্যাসপুর কমিউনিটিতে পৌঁছে যাই। আমাদের স্বাগত জানাতে আসেন প্রকাশ ভাইয়া। সেখানে গিয়ে দেখা হয় যশোর থেকে আসা পার্টনার সংস্থা DHARA-র সাথেও। বাজারে একসাথে চা খাই, তাদের স্কুলটা একটু ঘুরে দেখি। এরপর কমিউনিটির এক কিশোর আমাদের প্রোগ্রাম ভেন্যুতে নিয়ে যায়।

ভেন্যুতে পৌঁছে আমরা সত্যিই অবাক হয়ে যাই।

খোলা উঠান, রাস্তার ধারে—কিন্তু কী সুন্দর আয়োজন! কমিউনিটির মানুষ নিজেদের হাতে সাজিয়েছেন পুরো জায়গাটা। একটি পরিপাটি মঞ্চ, কলসিতে আলপনা, নবান্ন আর মেলার সাজ—সবকিছুতেই ছিল নিজস্বতার ছাপ। এটা কোনো বাইরের আয়োজন নয়—এটা ছিল তাদের নিজের উৎসব, নিজের জ্ঞানমেলা।

আমরা সবাই উঠানে বসি। তারপর কলা পাতায় করে আমাদের পরিবেশন করা হয় নবান্নের পিঠা আর নাড়ু। সেই মুহূর্তে শৈশবের বনভোজনের কথা মনে পড়ে যায়—গ্রামে একসাথে বসে কলা পাতায় খাওয়ার সেই দিনগুলো।

পুরো আয়োজনটি ছিল পরিবেশবান্ধব। ময়লা ফেলার জন্য ডাস্টবিন, খাবার পানি, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা—সবই ছিল। ছোট ছোট বিষয়েও যে সচেতনতা, তা সত্যিই অনুপ্রেরণার।

এরপর শুরু হয় মূল প্রোগ্রাম। একে একে বিভিন্ন দল তাদের গল্প শেয়ার করে।

মায়েদের দল জানান, কীভাবে তারা এখন সন্তানদের পড়াশোনা নিয়মিত ট্র্যাক করছেন, মোবাইল ফোনের আসক্তি কমাচ্ছেন। একসময় এই কমিউনিটিতে মেয়েদের বাইরে খেলতে দেওয়া হতো না। আর এখন—মেয়েরা ছেলেদের সাথে দল বেঁধে ফুটবল খেলছে। নিজেরাই খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে।

ম্যাসকুলিনিটি টিম শেয়ার করেন, আগে তারা নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে লজ্জা পেতেন। এখন পরিবারে সবার সাথে নিজেদের আবেগ, কষ্ট, অনুভূতি ভাগ করে নিতে পারছেন।

এরপর কথা বলেন গল্পের আসরের দাদি। তিনি জানান, মাসে দুই-তিনবার তিনি গল্পের আসর বসান, যেখানে অনেক শিশু গল্প শুনতে আসে। ডিজিটাল দুনিয়ার ভিড়ে তিনি গল্প বলার এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন।

সালমা আপা শেয়ার করেন তার গল্প। নিজের বাড়িতে সবজি বাগান করে তিনি সফলতা পান। এখন তিনি মাঠে সবজি চাষ করছেন এবং কমিউনিটির অন্যদেরও উৎসাহ দিচ্ছেন কীভাবে শুরু করা যায়। তাকে দেখে খুশি আপাসহ আরও অনেকেই সবজি চাষ শুরু করেছেন।

এরপর আমরা দেখি গ্রামীণ জীবনের আবহে একটি চমৎকার পরিবেশনা। পুরো জ্ঞানমেলাটি ছিল সুন্দরভাবে সাজানো। এটি প্রমাণ করে—শুধু লার্নিং সেশন নয়, শেয়ারিংয়ের মাধ্যমেও অনেক কিছু করা যায়। এটিই ছিল এই জ্ঞানমেলার সবচেয়ে বড় সাফল্য।

কমিউনিটির খুদে শিশুদের নৃত্য পরিবেশনা পুরো মেলাটিকে প্রাণবন্ত করে তোলে। তারপর শুরু হয় খেলাধুলা—বিস্কুট দৌড়, বস্তা দৌড়, হাঁড়ি ভাঙা, ঝুড়িতে বল ফেলা—সব খেলাতেই ছিল টানটান উত্তেজনা। সবাই ছিল মনোযোগী দর্শক।

শিশুদের খেলাধুলা আর উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে আমরা আর নিজেদের ধরে রাখতে পারছিলাম না। বারবার মনে হচ্ছিল—কিছু সময়ের জন্য হলেও যেন আমরা আবার শৈশবে ফিরে যেতে পারি। ছোটবেলার সেই নির্ভার আনন্দ, হাসি আর খেলায় মেতে ওঠার ইচ্ছেটা ভেতরে ভেতরে জেগে উঠছিল। সেই অনুভূতি থেকেই আমরা সাদিয়া আপুকে জানাই যে, আমরাও খেলায় অংশ নিতে চাই। সাদিয়া আপু এক মুহূর্তও দেরি না করে আমাদের সঙ্গে শিশুমনের মতো মিশে খেলাধুলার আয়োজন করেন। এরপর ঝুড়িতে বল ফেলার খেলায় আমরা কোহর্টের সবাই অংশ নিই এবং পুরো মুহূর্তটুকু প্রাণভরে উপভোগ করি। খেলাটিকে আরও আনন্দময় করে তুলতে আশিক ভাই সবার জন্য মজার মজার গিফট ঘোষণা করেন।

হাসি-আনন্দের মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে জ্ঞানমেলা ও নবান্ন উৎসবের সমাপ্তি ঘটে। সবাই একসাথে বসে দুপুরের খাবার খাই। BRED টিম, Alokito Kori টিম ও DHARA টিম তাদের নিজ নিজ কমিউনিটির গল্প ব্যাসপুর কমিউনিটির মানুষের সাথে শেয়ার করেন।

সাদিয়া আপু, প্রকাশ ভাই, মুনিরা আপু ও প্রিয়া আপুর আন্তরিকতা, যত্ন আর ভালোবাসা, আর ব্যাসপুর কমিউনিটির মানুষের হৃদয়ভরা আতিথেয়তায় আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। ১৫ ডিসেম্বর তাই আমাদের স্মৃতির পাতায় লেখা রইল একটি সোনালি দিন হিসেবে।

এই সুন্দর আয়োজনে আমাদের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সাদিয়া আপুকে আন্তরিক ধন্যবাদ। আর বিশেষ কৃতজ্ঞতা হুমায়রা আপুর প্রতি, যার উদ্যোগেই শেষ পর্যন্ত আমরা এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার অংশ হতে পেরেছি।

যখন কমিউনিটি নিজেই নেতৃত্ব দেয়, তখন জ্ঞান শুধু শেখায় না—
জ্ঞান তখন উৎসব হয়, সম্পর্ক গড়ে তোলে, আর মানুষকে বদলে দেয়।

Views: 24

Comment

You need to be a member of Community life competence to add comments!

Join Community life competence

Comment by Rowshon Benthi Hossain 13 hours ago

অনেক ভালোবাসা & কৃতজ্ঞতা আপু এতো সুন্দর আয়েজনের জন্য & আমাদের ইনভাইটেশন এর জন্য ❤️❤️।

Comment by Sadia Jafrin 13 hours ago

অনেক ধন্যবাদ আপনাদের যে এতো কষ্ট করে আপনারা এসেছেন। আপনাদের অতিথি না মনে হচ্ছিলো একদম সবার সাথে মিশে যাওয়া কমিউনিটির মানুষ। আমরা অনেক কৃতজ্ঞ। লেখাটা খুব ভালো হয়েছে। 

© 2025   Created by Rituu B. Nanda.   Powered by

Badges  |  Report an Issue  |  Terms of Service